বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১০

“Yes, YOU! You answer the question!!”

...মেজাজটা এত্তো গরম হয়েছিল!!! বলার মত না। মাত্র ফার্স্ট সেমেস্টার শুরু হল- তখনও আমি মানুষের সামনে কথা বলা একদমই পছন্দ করি না, ক্লাসে প্রশ্নের উত্তর দেয়া তো দূরে থাক! সেখানে কেন এই স্যারটা ক্লাসের এত্তো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে বেছে বেছে আমাকে দাঁড়িয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে বললেন? দাঁড়ালাম ঠিকই, উত্তরটাও মাথায় আছে, কিন্তু মুখ থেকে কিছু বের হলোনা। ক্লাসের ৬৫ জোড়া চোখ আমার দিকে তাকানো – আর আমি দাড়িয়ে আছি ‘হা’ করে!! পাশ থেকে কে যেন ফিস ফিস করে উত্তরটা বলল, সাথে সাথে স্যারের আদেশ- “No, I asked her to answer. Let her speak up”. মেজাজ খারাপ এর সাথে সাথে মনটাও এবার বিরক্তি আর তিক্ততায় ভরে গেল। এটা কেমন কথা? এরকম টর্চার এর মানে কি? কোনরকমে মুখ থেকে কিছু একটা বের করে বসে গিয়েছিলাম। আর এইটুক মনে গেঁথে গিয়েছিল- এই স্যার আমাকে দেখতে পারেনা, নাহলে সবার সামনে এরকম হেনস্থা করার মানে দেখিনা…….

কিন্তু যতই দিন গড়িয়েছে, স্যার সম্পর্কে আমার মনে গেঁথে যাওয়া সেই ধারণাটি পুরোপুরি দূরে ছুড়ে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছি আমি। IBA এর কালচারই হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের একদম পানিতে ফেলে দেয়া এবং এরপর বলা- “এবার সাতার শিখো”। ক্লাস প্রেসেন্টেশান এর সময় যারা কথা বলতে পারতোনা বেছে বেছে তাদেরকেই প্রশ্ন করতেন স্যাররা, আর যারা পারত তাদের অপেক্ষা করতে হত কখন তাদের সেই হতভাগা গ্রুপকে উদ্ধার করতে পারবে। আর স্যার ঠিক সেটাই করেছিলেন। ক্লাসে তখনকার সবচেয়ে কম কথা বলা ছেলে মেয়েদের মধ্যে একজন ছিলাম দেখে আমাকে জোর করে কথা বলানো আরকি। প্রথম দিন ক্লাসে এসে তিনি বলেছিলেন, “I have also studied here. So I know the tricks too. I know how we behaved when we were in class. The things haven't changed. I know everything, which teacher is known as what?” (প্রতিটা স্যার/ম্যাডামদের কোড-নেম থাকত, যে কোড তার নামের চেয়ে বেশি ব্যবহার হত. যার ফলে অনেক সময় কোনো কোনো স্যার এর আসল নাম বলে ফেললে ২ বার চিন্তা করে বের করতে হত কার কথা বলা হচ্ছে?)”……একজন স্যার এর মুখ থেকে এটা শুনে অবাক হয়েছিলাম; কি সুন্দর নির্দ্বিধায় বলে যাচ্ছে নিজেদের নামেই!!!

এরপর আরো দু’টো কোর্স করতে হয়েছে এই স্যার এর সাথেই। ততদিনে আল্লাহর অশেষ দয়ায় আমি আমার বোবাগিরী ছেড়ে দিয়েছি - ক্লাসে মুখ দিয়ে কথা বের করতে অতোটা কষ্ট হয়না। সেজন্য স্যারকে আর বলতে হয়নি – “Yes, YOU!!”

BBA এর শেষ সেমেস্টারে একটা কোর্স ছিল – “International Economics”, যে কোর্স অনেকেই নিয়েছিল কারণ স্যার নিবেন কোর্সটা। কোর্সে যে প্রজেক্ট দিয়েছিলেন সেটা ছিল IMF এবং World Bank এর উপর – “Critical Analysis on IMF/World Bank”. ঐ একটা কোর্স করে পুরোপুরি জানা হয়ে গেল - এই প্রতিষ্ঠানগুলো কতখানি বিতর্কিত পুরো দুনিয়া জুড়ে, কিন্তু সেটা চাপা থেকে যায়। ব্যবসা ও পণ্যকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করা শিখিয়েছিলেন ২ জন লেকচারার, স্যার তাদের মধ্যে একজন।

এক এক দিন এক এক গ্রুপ এর প্রেসেন্টেশান চলছে, স্যার ও দিয়ে যাচ্ছেন ওনার মন্তব্য। একদিন এক গ্রুপ - পুরাই ফাঁকিবাজী করে আগের এক কোর্সের কাজ copy-paste করে প্রেসেন্টেশান দিয়ে দিল। আমরা সবাই চুপ, স্যারও কিচ্ছু বললেন না প্রেসেন্টেশান এর সময়। সবকিছু যখন শেষ - তখন উনি শুধু ঐ গ্রুপ-লিডারকে বললেন, “Is this a joke you're playing with me? I never expected this from you. Can you give a valid reason why you did this?”…… স্যার এর গলা কোনোদিন উচু করতে হয়নি, ঠাণ্ডা মাথায়, ঠাণ্ডাভাবেই কথা গুলো বললেন। এরপর আর ঐ গ্রুপ এর ছাত্রদের চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিলনা, লজ্জায় তারা স্যার কে কোনো উত্তর দেয়নি। পরে শুধু এটুক বলল আমাদেরকে, “স্যার এর সাথে কাজটা করা ঠিক হয়নি। অন্য কোনো স্যার এই কথাগুলো বললে কিছু যায় আসে না। কিন্তু এই স্যারের সাথেই হলো এটা!!” পরে অবশ্য অন্য একটা রিপোর্ট দিতে হয়েছিল তাদের। আমাদের প্রেসেন্টেশান এর সময় - পুরো multimedia system গ্যান্জাম করলো- প্রথমে প্রজেক্টর গেল বন্ধ হয়ে, তার কিছুক্ষণ পর কম্পিউটারও!! স্যারও নাছোড়বান্দা - কম্পিউটার ছাড়াই প্রেসেন্টেশান করতে হবে!!! গেলো! সারা রাত ধরে কষ্ট করে কাজ করা সব পানিতে গেলো তো গেলোই, তার মধ্যে স্লাইড না দেখে কি বলব?? শুরু করলাম কোনো গাইড ছাড়া। কোনো মতে গ্রুপের ৩ জন শেষ করার পর - স্যার এর মন্তব্য শুরু হলো।

আমার বেলায় যখন আসলো - ঐ মূহুর্ত আমি ভুলতে পারব কিনা জানিনা, তার কথাগুলো এখনো মাথায় গেঁথে আছে। “She has come far enough. I remember the first semester - she couldn’t speak up! This is the improvement I wanted to see. Now you can go anywhere and I will be confident that this is the type of people we would like to see going out there and speaking out to everyone. This is the confidence you need - you don't need the slide or paper. Thank you!”. আরো কি বলেছিলেন মনে নেই। কিন্তু একদম শুরুর দিকের সেই – “Yes, you! You answer the question!!”…… ঘটনার মাহাত্ম্য ঐদিন পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, এখনো পারি। আমি এখন যেখানে আছি সেখানে আসতে, আল্লাহর রহমতে কিছু মানুষের কাছ থেকে শিখে আসতে হয়েছে। আর স্যার হলেন তাদের মধ্যে একজন।

স্যারকে গত ৬ মাস ধরে গৃহবন্দী করে রেখেছে সরকার, গতকাল রিমান্ডে নেয়া হয়েছে স্যারকে। এই দেশের নেতা-নেত্রীদের এমনিতেই বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মিডিয়া আমার কাছে ধুয়া মনে হয় অনেক আগে থেকেই, তারমধ্যে স্যার এর উপর যেই দোষারোপ দেয়া হচ্ছে - তা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবনা। স্যার এতো shallow-minded মানুষ না। আমি শুধু এইটুক দু’য়া করি- স্যার এর উপর যেন কোনো দুর্ভাগার হাত না পরে। আর যদি পরে, আল্লাহ যেন তার সুবিচার করেন। আমীন।

৭টি মন্তব্য:

  1. আল্লাহ এই মহান মানুষদের বাঁচিয়ে রাখবেন সকলের অন্তরে স্থান দেয়ার মাধ্যমে........

    আর ঐ পশুগুলোর কাল হাত ইনশাল্লাহ ধ্বংস হয়ে যাবেই....... :@

    উত্তরমুছুন
  2. দুঃখজনক ব্যাপার হলো, তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হলেও ঢাবি কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত তার অনুকূলে কোনো বক্তব্য-বিবৃতি দেয় নি। উল্টো বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে তাকে।

    অথচ, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আগস্টের ঘটনায় ঢাবিতে সেনাবাহিনীর সাথে ছাত্রদের যে সংঘর্ষ হয়েছিল, তাতে ইন্ধনের অভিযোগে যেসব শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের বের করে আনতে কী বক্তব্য-বিবৃতিই না দিয়েছে ঢাবির শিক্ষকরা আর সুশীল সমাজের সদস্যরা! সেসব শিক্ষকদের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তারা যেকথাটি বারবার বলতেন সেটা হলো, "মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র ঢাবিতে শিক্ষকরা ভালো মনে করে যা করেছেন, তাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। তারা জাতির বিবেক। তাদের মুক্তচিন্তার জন্যে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হলে জাতির অবমাননা হয়।"

    সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষের ওসব শিক্ষকের ইন্ধন দানের স্পষ্ট প্রমাণ ছিল। তাসত্ত্বেও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র ঢাবির শিক্ষক হওয়াতে তাদের ছাড়া মেলে। কিন্তু, এই শিক্ষকের বেলায় সেই সূত্র প্রযোজ্য হয় না কেন? যে ক'টা জায়গা ঢাবির জন্যে অত্যন্ত গর্বের তার একটাতে তিনি কর্মরত। তার কি মুক্তচিন্তার অধিকার নেই?

    উত্তরমুছুন
  3. আই বি এ থেকেও কি কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ওনার জন্য? আমি যতদূর জানি আইবিএ-র একটা গা-বাঁচানো কালচার আছে। আড়চোখে তাকিয়ে সহকর্মীর বিপদে পড়া দেখে না-দেখার ভান করে নিজের আখের গুছিয়ে নেবে। এইই যদি আইবিএ হয় তবে ঢাবি'র দোষ দিয়ে লাভ কী?

    উত্তরমুছুন
  4. আপনাদের স্যারের জন্য দোয়ায় সামিল হলাম । এছাড়া আর কি-ই বা করতে পারি.. আল্লাহ উনাকে সম্মানিত করুক.. খুব শিঘ্রী....

    উত্তরমুছুন
  5. আপনি স্যারের যে বর্ণনা দিলেন, তার মত মানুষকে রিমান্ডে নেয়া জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জা!

    উত্তরমুছুন
  6. কিরকম একা হয়ে গেলেন স্যার- আমি ওটাতেই অবাক হই; কেউ ওনাকে সাহায্য করছেনা, কেউ কিচ্ছু বলছেওনা ! কত লজ্জা বয়ে বেড়াবে এই দেশ একমাত্র আল্লাহই জানেন| ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি কোনো নৈতিকতা মেনে চলে?! IBA তো খুবই স্বাভাবিক ভাবেই চলছে :-(

    আল্লাহ ওনাকে সাহায্য করুন!

    উত্তরমুছুন
  7. উনার দোষ যে কি ঐটা সবাই জানে। ঐযে আপু সূরা বুরুজের ৮ নং আয়াতটা আছে না?

    উত্তরমুছুন