অনেকদিন ধরে লেখা হচ্ছেনা। আসলে লেখার জন্য যেই ছোট একটা push লাগে, সেটা খুঁজে পাচ্ছিলামনা। ২-৩ দিন আগে আন্ডা-বাচ্চাকালের এক বান্ধবী সেই আদিম কালের একটা ছবি ফেসবুক-এ পোস্ট করে দিল। ছবিতে আমাদের সবার চুল দেখি একই ধাঁচে কাটা! চুল ঝুঁটি করার মত বড় হয় নাই-- কিন্তু তাও চুলগুলো টেনে সে ঝুঁটি বেঁধে সজারুর কাঁটার মত মাথার উপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া। ক্যামেরার সামনে সব আঁটশাট হয়ে দাঁড়িয়ে-- লাইন ধরে ছবি তুলছি আমরা। এক একজনের চেহারায় সেরকম এক্সপ্রেশন! ছবি দেখে হাজার স্মৃতি একের পর এক এসে মনে ভীড় করলো। মনে হলো এইতো সেদিনের ছবি! কিন্তু বছর হিসেব করে দেখলাম ছবিটা প্রায় ২ যুগ আগের! নিজেকে কেমন বুড়ি মনে হলো (obviously!); সেই ছোটবেলার নিরীহ . এখন আমরা সবাই দেশে. কিন্তু আমাদের ছোটবেলা দেশে কাটেনি. তাই অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন ধরনের ছিল. আশেপাশে বাংলাদেশী ছিল হাতে গোণা। যারা ছিল - তারা নিকট আত্মীয় থেকে কোনো অংশে কম তো ছিলই না, বেশি কিছু ছিল নাকি সেটা বিবেচনার বিষয়।
থাকতাম সৌদিতে - একদম দক্ষিণে, লোহিত সাগরের ধারে তুলনামূলক ছোট একটা শহরে। ওখানে রিক্সা বা বেবিট্যাক্সি মার্কা বাহন না থাকায়, বাবারাই ছিলেন একমাত্র চালক. তাই সবার বাবার চাকুরীর কারণে সারা সপ্তাহ বাসায় কাটাতে হত। আরবী স্কুল ছাড়া কোনো স্কুল ছিলনা, তাই স্কুল-বঞ্চিত ছিলাম। আমার বাবা/মা দু'জনই চাকুরী করায় আরেক ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যা নিয়ে হয়ত সামনে আরেকদিন লিখতে হবে। সপ্তাহে একদিন আমাদের re-union হত।কারো না কারো বাসায় বাবা-মা তাদের পোলাপাইন সহ উপস্থিত হতেন। নিজেদের মধ্যে সিরিয়াস আলাপ আলোচনা; আর আমাদের সে কি আনন্দ! একসাথে বারো-চোদ্দটা বাচ্চা এক জায়গায় - বাবা/মাদের আলাপের ঘর ছাড়া আর যেকোনো জায়গায় যা ইচ্ছা করা। এক একজন এক এক প্রকৃতির...আকার আকৃতিও এক এক ধরনের. একবার এক আন্কেল একটা কার্টুনএর সাথে আমাদের তুলনা করেছিলেন (সেই আঙ্কেলের তখন ৪টা আন্ডা-বাচ্চা আমাদের মধ্যে ছিল)। কার্টুনটার নাম ছিল 'captain majed' - যেখানে জুনিয়র ফুটবল খেলার দৃশ্য থাকত। এক খেলোয়াড় অন্য খেলোয়াড় এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা - কেউ চশমা পড়া-কারো চোখ ছোট, কেউ মোটা - কেউ চিকন, কেউ সরল রেখায় চলে - কেউ একটু চালাক; কিন্তু গোল করার সময় ঠিকই করে! এই তুলনার পেছনের কাহিনী বুঝার বুদ্ধি তখন গজায় নাই - তাই শুধু শুনেছিলাম। কিন্তু এখন চিন্তা করলে মনে হয় আসলেই তো! সেই কাহিনী মনে পড়লে শুধু মনে হয় - ইয়া আল্লাহ! কি চিন্তাধারা ছিল আমাদের! অদ্ভূত কিন্তু নিরীহ! আলাদা ধরনের সুন্দর একটা উপলব্ধি। খুব মিস করি এখন!
আমাদের re-union এর এক এক মেম্বার-এর কিছু কাহিনী নিচে তুলে ধরা হলো। (নিচে সবার ছদ্মনাম দিতে হচ্ছে , যাতে বিব্রত বোধ না হতে হয় :-D; এরপরও যদি পরিচয় প্রকাশ হয়ে পরে - তাহলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ করা হলো)।
সৌদিতে গিয়ে আমার সমবয়সী (আমার তখন বয়স ৪ বছর) প্রথম একজনকে দেখে খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। সে নিজের মধ্যে একটা ভাবগাম্ভীর্য বজায় চলত আর সবাইকে পরামর্শ দিতে বেশ পছন্দ করত। কিছু আরবী কথা বলায় আমি মেনে নিয়েছিলাম সে অনেক জ্ঞানী। আমার তখন লম্বা চুল এর প্রতি খুব কদর ছিল-- 'ফাহিমা' সেটাতেও এগিয়ে. তাই আমি তাকে আমার 'best friend' বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। আস্তে অস্তে যখন আমাদের আন্ডা-বাচ্চা গ্যাং এর মেম্বার বাড়তে লাগলো-- তখন দেখা দিল ছোট্ট সমস্যা। তাকে ছাড়া অন্য কারো কথায় মনোযোগ দিলেই সে মাইন্ড করে বসত-- এমনকি কথা বলাও বন্ধ করে দিতো! গালটাকে ফুলিয়ে দুরে গিয়ে বসে থাকত, মায়েদের সিরিয়াস আলাপ তখন তার কাছে শ্রেয় মনে হত। সেজন্য কথা বলার সময় খেয়াল রাখতে হত যাতে কিছুক্ষণ পরপর ওর চোখে চোখ রেখে কথা বলি- - সে তখন তুষ্ট চিত্তে ফিরে যেত। ওর ছোট বোনটা ছিল একটু নিরীহ প্রকৃতির, একটু কিছু হলেই কেঁদে দিতো! :-D পরের দিকে ওদের একটা ভাই হয়েছিলো-- খুবই গুব্দু গাব্দু, ফর্সা করে। কিন্তু ওই পিচ্চিকে নিলেই ওরা ভয় পেত যে ওদের ভাইকে কেউ নিয়ে যাবে। ওখানে একসঙ্গে থাকার আরেক বৈশিষ্ট্য ছিল - একসাথে journey করা। আমাদের ওখান থেকে মক্কা যেতে লাগত পুরা ১ দিনের মত। ফাহিমাদের গাড়িটা ছিল station wagon; যেখানেই যাই না কেন -- সব আন্ডা বাচ্চার সীট ছিল ওই গাড়ির পিছনের হুড-এ; রাস্তায় একটা দেখার বিষয় হত বটে। একসাথে এত্তগুলা বাচ্চা পিছনে করে নিয়ে যাচ্ছে একটা গাড়ি!
আমার সমবয়সী আরেকজন ছিল 'সুহা'. এক্কেবারে ভদ্র চেহারার অধিকারিণী-- যাকে দেখে মনে হত একটু 'বেশি ভালো'। আর আমার মা সব সময় ওর সাথে তুলনা করতে ভুলতেন না—“দেখেছ, কি সুন্দর করে ভাইটার যত্ন নেয়?”, “ও কত কাজ করে বাসার”,”ওর মাকে কত help করে”! মাঝে মাঝে মনে হতো-- ওর সমস্যাটা কোথায়? পরে অবশ্য ওর সাথে কথা বলে আবিষ্কার করেছিলাম ওর মা আমাকে দেখিয়ে ওকে একই কথা বলে। এরপর থেকে সেই কথার মূল্য কতখানি দেওয়া হয়েছিল মনে নাই। ওর একটা বড় ভাই ছিল-- যে সেলাই থেকে শুরু করে রান্না পর্যন্ত পারতো। একবার বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে দেখা গেল ২-৩ টা আইটেম ওই ভাইয়ার বানানো কোন একদিন এক জামা পরে এসে দেখালো-- ওই জামা নাকি ওই ভাইয়া বানিয়ে দিয়েছে। ব্যস!! মায়েদের ‘আদর্শ' বাচ্চার ক্যাটেগরী তে ফেলা হলো ওই পরিবারের বাচ্চাগুলা কে!
(To be Continued)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন