শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

আমাদের যারা টেনে চলেছে ঢাকার রাস্তায়....

১. "I know, my friends..."

ঘটনাটা বেশ আগের। তখন O-level পরীক্ষার জন্য কোচিং করছি হরদম। Physics পড়তে যেতাম গ্রীনরোড-এ এক স্যারের কাছে। বাসা থেকে রিকশা করে যেতে ১০ থেকে ১২ টাকা লাগত। ১০ এর নিচে কেউ দাবি ও করত না। মাঝে মাঝে উর্ধ্বে ১৫ টাকা চেয়ে বসত “রিকশাওয়ালা” ভাইয়েরা।

যাই হোক - ঠিক এরকম এক বিকেলে আমরা দু’ ভাই বোন রিকশা ভাড়া করছিলাম। একজন রাজি হলো গ্রীনরোড যেতে - লম্বা, মধ্যবয়সী, পাতলা সাদা শার্ট এবং লুঙ্গি পড়া। ভাড়ার কথা জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে নির্দ্বিধায় বলে ফেলল “আট টাকা”। আমরা তখন অবাক হয়ে তাকে বললাম “আপনি চিনেন তো?”। সে বলল, “হ্যাঁ, চিনি”। উঠে গেলাম। কিছুদূর যাবার পর আমরা নিজেরা কথা বলতে লাগলাম ইংরেজিতে, যাতে আমাদের রিকশাওয়ালা ভাই না বোঝে। এক পর্যায় গিয়ে বললাম 'For sure - he doesn't know the place. Why will he ask for 8?' ব্যাস! সাথে সাথে সে বলে উঠলো 'I know, my friends. I know the place - believe me. You may not get how I speak English. I am pulling a rickshaw - that is my luck.' ততক্ষণে আমাদের চোখ কপালে আর লজ্জায় মাথা নিচু। কিছু বলার মত সাহস বা মানসিকতা - সব চলে গিয়েছে। সে কথা বলেই চলল। 'I have stayed in Saudi Arabia, Kuwait and other countries. It is my luck. It is not that I cannot read or write. I have lost everything. Now I am taking you in this rickshaw - as you can see...'. (আমি এখানে একটুও বাড়িয়ে বলছি না!)

এরপরও সে আরো কথা বলে চলেছিল ইংরেজিতে। কিন্তু আমার শুধু এটুকুই মনে আছে। এখন খুব ইচ্ছে হয় জানতে যে এরকম একজন মানুষ কিভাবে সেদিন রিকশা করে আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছিল? কিন্তু ঐদিন একটুও ইচ্ছে করেনি - কারণ আমরা তাকে ইংরেজিতে মূর্খই ভেবেছিলাম। এবং সে সেটা বুঝেই ওভাবে আমাদেরকে উত্তর দিয়েছিল। আমরা নেমে গিয়ে তাকে ১২ টাকা দিয়েই চলে গিয়েছিলাম। পিছে আর তাকিয়ে দেখিনি - লজ্জায়। কিন্তু এখন মনে হই আমরা সেই লজ্জা এখনো বয়েই বেড়াচ্ছি সামাজিকভাবে। আর এরকম আরো মানুষ আমাদেরকে রাস্তায় টেনেই চলেছে।

২. 'আস্সা, যাই'

যেই গরম পড়েছে। এখনো বৈশাখ মাস আসেনি - আসলে না যেন কি হবে! বাইরে বেরোলেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আর হাত পা মনে হচ্ছে পুড়েই গেল। তাও সে দুপুর ১২:৩০ - সূর্যটা একদম পূর্ণভাবেই ছড়িয়ে চলেছে তার তাপদাহ! আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে যে “রিকশাওয়ালা”, বয়স তার ৩০-৪০ এর মধ্যে। মাথার চুল সব ফেলে দিয়েছে - গরমেই - মনে হলো। সে কিচ্ছুক্ষণ পর পর হাপাচ্ছে। রাস্তায় এক জায়গায় রিকশা থামিয়ে সে দেখলাম পানি খেল। আবার টানা শুরু করলো রিকশা। সারা রাস্তা তো আর চেহারা দেখতে পাইনি। বাসার সামনে নেমে দেখলাম - চেহারা পুরোপুরি লাল হয়ে গিয়েছে। খেয়াল করলাম তার হাপানোর অবস্থা স্বাভাবিক না। কিন্তু আমি ডাক্তারও না - জিজ্ঞেস করে সমাধান তো দিতে পারবোনা। ভাড়া দেবার সময় তার ইতস্থতভাব। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব - তার আগেই সে বলল, “আফা, একটু পানি হইব?” পানি - যে জিনিস দিতে কোনো শ্রম, টাকা কিছুই লাগেনা - সে জিনিস চাইতেও তাদের সেই পরিচিত ইতস্ততা। “আফা, যদি ঠান্ডা হয় - তয়লে একটু বেশি দিয়েন” - বড় একটা হাসি দিয়ে বলল।

পানি নিয়ে নীচে নামতে নামতে দেখি - বাসার সামনে থেকে তাকে সরে যেতে বলা হচ্ছে। অপরিচিত এক “রিকশাওয়ালা” গেট এর সামনে বসে আছে - এটা দেখেও কিছু লোক বিরক্ত হলো। “এরকম করে বসার জায়গা নাকি বিল্ডিং এর সামনে? তাও আবার সে পা ছড়িয়ে বসে আছে!”, ২জন একসাথে বলে উঠলো। গেট দিয়ে বের হতে হতে দেখি সে রিকশা নিয়ে চলে যাচ্ছে। পানির কথা মনে হই ভুলেই গিয়েছে ভয়ে। যখন পানি নিয়ে সে রিকশা চালিয়ে চলে যাচ্ছিল - পুরা ছোট বাচ্চাদের মত হাত নাড়াতে নাড়াতে চলল - আর বলল “আস্সা, যাই”।

এখন তার হাপানি কি অবস্থায় আছে কে জানে? চিকিত্সার জন্য কতই বা খরচের ভয়ে এরা ক্লিনিক এ যেতে পারেনা? এরা সমাজ এ তাড়ানোর অবস্থাতেই বেচে আছে। কিন্তু তাও এরা আমাদের টেনেই চলেছে ঢাকার রাস্তায়!

৩. 'একটু জায়গা দেবার যাইবো?'

রমজান মাস। একদম আসর এর সময় আমি ধানমন্ডি থেকে বাসায় ফিরছি। যেই রিকশায় ফিরছিলাম - 'রিকশাওয়ালা' একদম বৃদ্ধ। সাদা চুল, সাদা দাড়ি। বয়স এর ভারে কুজো হয়ে গিয়েছে। তারপরও কষ্ট করে টেনে চলেছে এই রিকশা নামের বাহনকে - আমাকে নিয়ে। এক পা দিয়ে pedal টা খুব জোড় দিয়ে নীচে নামাচ্ছে - যখন তার পুরো শরীর এর ভার ওই পায়ের উপড় পরছে - অন্য পা টা তারপর ফেলছে অন্য pedal টা চালাতে। ধানমন্ডি থেকে মোহাম্মদপুর - এরকম কয়শত বার পা ফেলেছে কে জানে! সারাটা রাস্তা এভাবেই নিয়ে আসলো।

বাসার সামনে এসে তাকে যখন ভাড়া দিতে যাব তখন সে আমার দিকে তাকালো। কিছু একটা বলতে গিয়েও - সংকোচে বলতে পারছে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ভাড়া ঠিক আছে?”। তখন সে বলল “হ, ঠিকই আছে”। কিছুক্ষণ পর সে আবার তাকালো আর তখন খুব সাহস নিয়ে বলল “আফা, এই বাসা কি আপনাগো?”। আমি বললাম “হ্যাঁ, কেন?” সে তখন আরেকটু ইতস্তত করে বলল, “আফা, এট্টু জায়গা দেবার যাইবো?”। আমি তো বুঝলাম না। কিসের জায়গা চাচ্ছে? তখন সে আবার বলল “আফা যদি অল্প এট্টু জায়গা দিতেন কয়টা মিনিট এর জন্য, আমি এট্টু আসর এর নামাজ টা পড়তাম। সময় আর থাকত না বাসায় পৌসাইয়া”। আল্লাহু আকবার! তখন মনে হচ্ছিল, আল্লাহ মনে হয় এসব অভাবী লোকদের কথাই বলেছেন - যারা বিনা হিসেবে বেহেশতে চলে যাবে! কারণ আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়াতে অনেক অল্প দিয়েছেন, অভাবে রেখেছেন - কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান ঈমান টা দিয়েছেন। এই ২টার জোট হয়তো তাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে - শিক্ষার অভাবে সে হইতো সেটা জানেও না। তার নামাজ পড়া দেখলাম অল্পক্ষণ দূর থেকে দাড়িয়ে। কি শান্তিতে সে নামাজ পড়ল - ধীরে ধীরে, একদম একাত্বতার সাথে।

আমরা যারা ধর্ম সম্পর্কে মানুষকে বলতে যাই, তখন কয়জন এদের কথা মাথায় রাখি? আমরা এদের কাছে কেন এগিয়ে যাইনা - যেখানে তারা এক পায়ে দাড়িয়ে আছে শুনে এবং মেনে নেবার জন্য? অথচ কোরআন এর সব জায়গায় এসব মিসকীনদের কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন আল্লাহ। আসলেই - অবহেলীত মানে সব দিকেই অবহেলীত!

========================================================

“আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচার দিবসকে মিথ্যা বলে? সেই তো ব্যক্তি, যে এতিমকে গলা ধাক্কা দেয়। এবং মিসকীন কে অন্ন দিতে উত্সাহিত করেনা। অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাযীর যারা তাদের নামাজ সম্মন্ধে বেখবর। যারা তা লোক দেখানোর জন্য করে। এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্তু অন্যকে দেয়না”। [সূরাহ মাঊন]

1 টি মন্তব্য:

  1. অনেক আগে পড়েছিলাম এই লেখাটা। তবে লেখাটা যে আপনার সেটা আজকে জানলাম। :-)

    শত সহস্র ফেরেশতা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে
    যখন মনুষত্ব ভুলে মোরা আছি পশুর স্তরে

    উত্তরমুছুন