বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন, ২০১০

কিছু অধিকার ও খোলামনের মানুষ ...


ছোট বেলার অনেকটাই কেটেছে সৌদিতে। সে দেশ নিয়ে অনেক দেশের অনেকের অনেক সমালোচনা - অল্পকিছু ঠিক আর বেশিরভাগ অতিরঞ্জিত। স্বচক্ষে না দেখলে হয়ত সে দেশ নিয়ে সেই অতিরঞ্জিত ধারণা নিয়েই থাকতাম। মানুষজনের সে রঞ্জিত বর্ণনা শুনে মনে হবে ওখানকার নারীরা জেলখানা থেকেও নিকৃষ্ট কোনো জায়গায় বসবাস করে, তাদের অধিকার বলতে কিছু নেই। আর সম্মান? সেটার তো প্রশ্নই উঠে না। এসব কথা শুনে হাসি পায় - অনেক!

যে দেশে মহিলাদের জন্য exclusive মার্কেট করা হয়েছে - যেখানে ক্রেতা, বিক্রেতা সবই মহিলা; যে দেশে বাসায় মহিলা মেহমান আসলে - পুরুষ গুলাকে বাসার বাইরে বেড়িয়ে যেতে হয় মহিলাদের privacy দেবার জন্য; যে দেশে যৌতুক এর তো প্রশ্নই উঠেনা - বরং মোহরানা দিতে গিয়ে পুরুষ দের হিমশিম খেতে হয়; যে দেশে কোনো মহিলা বিধবা হয়ে গেলে আর তার কোনো সচ্ছল guardian না থাকলে সেই দেশের সরকার তার সম্পূর্ণ ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করে; যে দেশে রমজান মাসে রাত ১২টার পরে বাজারে মহিলারা নিশ্চিন্তে ঘোরাফিরা করে; যে দেশে পর্দার ভিতরে থেকে মহিলারা বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছে; যে দেশে একটা মেয়ের রূপ সৌন্দর্যের প্রচার তার ‘মূল্যবৃদ্ধি’ তে সহায়তা করেনা; সেই দেশ নিয়ে যখন এরকম রঞ্জিত কথা কানে আসে তখন খুব হাসি পায়।


আমি বলছিনা ওখানে একদম ১০০% ন্যায্য অধিকার দেয়া হচ্ছে। কিন্তু যে দেশের মানুষদের মুখে এসব সমালোচনা শুনি - সেই দেশের অবস্থা কি এর চেয়ে খুব ভালো? আমার নিজের দেশের কিছু 'আধুনিক' মানুষের মুখেও একই রকম কথা. এসব কথা যখন তারা না জেনে, ওই দেশের experience পাওয়া এই আমার সামনে এনে হাজির করে - তখন অবাক লাগে যে তারা কিভাবে নিজেদের মূর্খতার পরিচয় এভবে দিয়ে বেড়াচ্ছে। এরা আবার সেই গ্রুপ এর মধ্যে পড়ে - যারা একটা মানুষের বাহ্যিক ব্যাপার গুলাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। এই যেমন - যখন প্রথম প্রথম দেশে ফিরলাম - তখন দেখতাম আমার ডাক্তার মাকে দেখে এরা কেও বিশ্বাসই করতে চাইত না যে উনি ডাক্তার। কারণ? একদিকে কালো বোরখা পরা, সাথে আবার চেহরা দেখা যায় না - এই 'আধুনিক' যুগে সে ডাক্তার কেমনে হয়?! অবাক লাগত - যখন পরিচয় পর্বের সময় যিনি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তিনি 'ডাক্তার' শব্দটাকে একটু উচু স্বরে, একটু বেশি emphasis দিয়ে বলতেন যাতে শ্রোতার 'শুনতে ভুল' না হয়। হায়রে! ধর্ম আর যোগ্যতাকে তারা ২ মেরুতে রেখে দিয়েছে. একসাথে হতে দেয়াটা যাদের কাছে অস্বাভাবিক - এরকম 'ক্লোজড-মাইন্ড'-এর চিন্তাধারার লোকজনদের কে আমরা 'মডার্ন' হিসেবে গণ্য করছি।


এই চিন্তাগুলো মাথায় আবার আসতে শুরু করেছে - কারণ আমি আমার মা'র স্থলাভিসিক্ত হতে চলেছি! আলহামদুলিল্লাহ। এখন কোথাও যদি এই জাতীয় মানুষের সাথে পরিচয় হয় - তখন তাদের চেহারার অভিব্যক্তিতে একটা নিখুঁত ধারাবাহিকতা প্রকাশ পায়। প্রথম রাউন্ডে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে সালামের উত্তর, তারপর জোর করে ২-১ টা কথা - বেশিরভাগ সময় চেহারার দিকে না তাকিয়ে। দ্বিতীয় রাউন্ডে -- কথার মাঝখানে যখন সেই বোরখা পরা মেয়েটার মুখ থেকে ইংরেজি শব্দ বেড়িয়ে পড়ে (ভুলবশত) তখন আবার ঘুরে তাকায়। চেহারায় তখন একটু অবাক ভাব প্রকাশ পায়. তারপর অল্প একটু গুরুত্ব দিয়ে কথা বলা। এরপর হচ্ছে তৃতীয় রাউন্ড এবং এটা সবচেয়ে লক্ষণীয় -- যখন শুনে চাকুরিজীবি। চোখগুলো যায় বড় হয়ে, চেহারা একটু ফ্যাকাশে দেখায় আর মুখে তখন একটু হাসি হাসি ভাবও বেড়িয়ে আসে! আর আমি -- সেই "নিচু মনের " ধারাবাহিকতা দেখতে দেখতে কাহিল হয়ে যাই আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া ছাড়া কিছু করার থাকেনা।


এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান "আধুনিক" সমাজ। আমরা নৈতিক আর ধর্মীয় মূল্যবোধকে না জেনে - সেটাকে শো-কেসে উঠিয়ে রাখতে শিখেছি। আর যে নারী (কিংবা পুরুষ) সেই মূল্যবোধকে সামান্য ভাবেও ধরে রাখতে চায় -- তাদেরকে আমরা 'backward' হিসেবে ধারণা করে বসে থাকি। আমরা পাশ্চাত্যের culture কে রপ্ত করাটাকে আধুনিকতার সাক্ষর হিসেবে দেখতে শিখেছি। আর নারীর চরিত্রকে মূল্য না দিয়ে তাদের পোশাক আশাক আর 'get-up, set-up' এর দিকে তাকিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আর সেই আমরা সৌদি নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার স্পর্ধা রাখি।

======

এসব অবস্থার সাথে একটা website এ পোস্ট করা একটা কার্টুন আর আমাদের রাসুল (স) এর হাদীস এর কথা মনে পড়ে যায়। আর দু'আ করতে থাকি - এসব মানুষ যেন আসল খোলা মনের মানুষ হতে পারে। আমীন! হয়ত এটা দিন দিন আরো অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আল্লাহই ভালো জানেন।


সেই হাদীস: The Prophet [salaAllahu alayhi wa salam] said: Islam will begin as something strange and will go back to being something strange just as it began, so give glad tidings to the strangers..

৫টি মন্তব্য:

  1. দীর্ঘশ্বাস......
    মন বড়-ছোট'র যদি কোন অপটিমাম স্কেল থাকত! তাইলে কিছু বেকুবকে ফ্রি গিফট করতাম...

    তা-ও যদি কিছু শিখত!

    উত্তরমুছুন
  2. ইসলামি পোশাক পরলেই তাকে 'হুজুর' বলে খোটা দেয়াটা এখন একটা সামাজিক ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের অজান্তে আমরাও মাঝে মাঝে বলে ফেলি.. "ওই যে হুজুর মার্কা লোকটা/ মহিলাটা..."। আল্লাহ সবাইকে হেদায়াত দান করুন।

    উত্তরমুছুন
  3. যোগ্যতা যে ultimately ঈমানের যোগ্যতা দিয়ে মাপা হবে এটা সবাই ভুলে যায় !

    যদি কোনো এক সময় আমাদের রাসুল (স) আমাদের মাঝে হাজির হতেন
    - এসব narrow-minded লোকগুলো ওনাকেও এভাবেই মূল্যায়ন করত... আল্লাহ মাফ করুক!

    (আবার আমার নামে ধর্মীয় অনুভূতি তে আঘাত হানার মামলা না হয়! আমি মোটেও নিজেকে ওনার সাতে তুলনা করছিনা - ওনার আদর্শ যারা follow করতে চাই - কিছু জিনিস তো মিলেই যাবে - ওনারই তো উম্মত!)

    উত্তরমুছুন